Sunday, October 13, 2019

যেভাবে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হলাম

যেভাবে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হলাম



নূতন ধন চাকমা, সংবাদকর্মী।
পর্ব -১
আদো আদো মনে পড়ে
সেই ১৯৮৬ সালের কথা। তখন মায়ের দুধ পান করতাম। স্কুলে যায় কিনা মনে নেয়।
তবে বাসায় বাল্য শিক্ষা বইটি শেষ করা হয়েছে। ৭ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলাম।
প্রথম বড় বোন ২টি। সে পরে আমার বড় ভাই পভূ মুনি চাকমা। এর পর বড় বোন ৩টি। আর সবার ছোট আমি। বাবা'র মা অর্থাৎ আমার নানু আমার নাম দিলেন হরি মুনি চাকমা। আর আমার দাদু মা'র বাবা নাম দিলেন নূতন ধন চাকমা। আমার বাবারা ছিলেন তিন ভাই এক বোন। আর মা শুধু একা। কোনো ভাইবোন নেই। তাই বড় ভাইসহ ৫ভাই বোন হওয়ার পর মধুমঙ্গল পাড়া ত্যাগ করে বাবা-মা চলে যান খাগড়াছড়ির সদর উপজেলার শিব মন্দিরের পাশে জোর মরম গ্রামে( বর্তমানে রবিধন পাড়া)। সেখানে আমার আর বড় বোন সাগরিকা চাকমা ও আমা র জন্ম হয়। কয়েক বছর থাকার পর বাবা-মা আবার পানছড়ি উপজেলার পুরাতন গ্রামে চেঙ্গী ইউনিয়নে মধু মঙ্গল পাড়ায় আছে। মধু মঙ্হল পাড়ায় বাপের তোলা ঘর-বাড়ীতে এখনো থাকি। দু'টো নাম থেকে স্কুলের নাম হলো নূতন ধন চাকমা নামে।
১৯৯৮৬ সাল।গ্রামে তখন কোনো স্কুল ছিলনা। চেঙগী নদীর ঐ পাড়ে একটা প্রাইমারী স্কুল ছিল। দাদুরা নাকি তখন ছিলেন নদীর ঐ পাড়ে অনিল কার্বারী পাড়ায়।আপনর দাদুর নাম ছিল জয় মুনি চাকমা। বড় দাদু নাম ছিল কিস্ট মুনি পাড়া। দাদুরা ছিলেন সচেতন। ছিলেন প্রভাবশালীও। তাই বড় দাদুর নামে প্রাইমারী স্কুলের নাম বসে কিস্ট মুনি পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।
তখন চোর-ডাকাতের প্রভাব ছিল।সে ভয়ে আজুকে নদীর একুলে অর্থাৎ মধু মঙ্গল পাড়ায় স্থানান্তরিত হতে হয়েছে স্ব-পরিবারে। চেঙগী নদীটি ছিল স্রোতম্বিনী। চলতো তখন নৌকা। একটু বৃষ্টিতে নদীর দু'কুল বেগে যায়। তাই স্কুলে যেতে বারন করে সবাই। ছোটকালে স্কুলে যাওয়া হয়নি। সে চিন্তা করে গ্রামে একটি প্রাইমারী স্কুল তোমলার উদ্যোগ নেয় গ্রামের লোকজন। স্কুলের নাম দেয় মধু মঙ্গল পাড়া বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।
বড় ভাই প্রভূমুনি চাকমা তখন এসএসসি পাস করেছে। সে শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে বাল্য শিক্ষা শেষ করার পর ১ম শ্রেণি আর ২য় শ্রেণি না পড়ে ১৯৮৬ সালে সরাসরি ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেয় বড় ভাই। এর পর শুরু হয় স্কুল জীবন।তখনও আমি মা’য়ের দুধ পান করি।
স্কুলে প্রথম শিক্ষা গুরু ছিলেন আশুতোষ চাকমা। সে এসসসি পাস করেনি। তবুও খুবই ভালো পড়াতেন। এসএসসি পাস না করায় স্কুলের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করার পরও সে শিক্ষক হতে পারেনি। স্কুলে চেয়ার টেবিল ছিল না। বাঁশ দিয়ে চেয়ার, টেবিল, হাই বেঞ্চ ও ল বেঞ্চ তৈরী করা হয়েছে। বসলে প্রায় সময় পেশিগুলো বাঁশে চিপায় পড়তো।এভাবে বিরক্ত হতে হতে একটু বড় হয়ে কিষ্ট মুনি পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সে বছর পার্বত্য পরিস্থিতির কারনে অনেক লোক ভারতে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। শরনার্থী হওয়ার জন্য আমাদের পরিবারও যেতে হয়েছে। ভারতের সীমান্তবর্তী বাঘমারা এলাকায় আশ্রয় নেয় ১ সপ্তাহ পর্যন্ত। বাঘমারা যাওয়ার সময় পুরো পথ কিছু হেটে, কিছু পথ মায়ের কাল্লোঙ (বাঁশের তৈরী এক ধরেনের আদিবাসী সরঞ্জাম) এর উপরে, কিছু পথ বড় ভাই প্রভূ মুনি চাকমার কাঁধে করে যেতে হয়েছে। তখন খুবই ছোট ছিলাম। ছিলাম সবার আদরের।
হ্যা,ঁ বাঘমারা অর্থাৎ যেখানে শ্রীযুক্ত বাবু- মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার শ্মশ্বান ছিল। তখন তাঁর শ্মশ্বান দেখা হয়েছে অনেকবার। চারিদিকে বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। আর ছিল প্রকৃতির পাথর।
চলমান-২
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সেই বাঘমারা। সম্ভবত অনেক অনেক আগে সে স্থানে বাঘ মারা হয়েছে। তাই ঐ স্থানটি নাম বাঘমার রাখা হয়েছে। যেখানে জুম্ম জাতির অগ্রদূত সেই শ্রীযুক্ত বাবু- মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা শ্মশান ভূমি রয়েছে।
চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়। মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ী ছড়া। সেই ছড়ার পাশে শ্রী যুক্ত বাবু-স্বর্গীয় মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার শ্মশান ভূমি। তখনকার সময়ে  শ্মশানটি রাখা হয়েছে বাঁশের বেড়া দিয়ে। বেড়ার ভিতর প্রকৃতির ছোট ছোট পাথর। এটা বিগত ৩৩ বছর আগের কথা। অর্থাৎ ১৯৮৬ ইং সালের কথা। মনে হয় এখন আর সেই বেড়াগুলো আর পাথরগুলোও সেখানে নেই।
ঠিক বিঝুর পূর্ববর্তী সময়ে যেতে হয়েছে আমাদের। তাই সে সময় পাওয়া যেত ঘড়া 'বাচ্ছুরি'। আমরা সেই ঘড়া বাচ্ছুরি খোঁজার জন্য মিঃ লারমার শ্মশানের পাশে বড়দের সাথে বাচ্ছুরি খুঁজতে যেতাম।
যাওয়া হয়েছে অনেক বার। বড় জনের আমাদের বলতেন শ্মশানের ভিতরে পা না দেওয়ার জন্য।
আর অনেক অনেক  মানুষ তার শ্মশানে গিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা করে হাত জোর করে প্রণাম করত। মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রণাম করত। অনেকের চোখে জ্ল আসতো। তাঁকে ম্মরণ করে করে বিলাপ করতো। বলতো তিনি খুবই মহৎ মনের মানুষ ছিলে। ছিলেন অমায়িক, মৃতভাষী,তিনি নিজেই প্রাণী হত্যাও করতেন না। থাকতেন খুবই সাদাসিদে ভাবে। মাঝে মাঝে নাকি ছিঁড়া কাপড় দিয়েও থাকতেন। তিনি যে কুয়ায় স্নান করতেন সে কুয়ায় থাকতো কাঁকড়া, মাছ বেগেনা। সেই মাছ,কাঁকড়া গুলোকে খাবার দিতেন। সে সব প্রাণীদের না মারার জন্য তাঁর সাথে থাকা কর্মী সব সময় বললেন। সেই শ্মশানের পাশে পাহাড়ে ছিল তাঁর থাকার 'ব্যারেকটি। তিনি নাকি ব্যাক্তিগতভাবে ধার্মীক ছিলেন। এসব লোক মুখে শোনার কথা।
আমি তখন ছোট ছিলাম। ছোট একটা 'দা' নিয়ে বড়দের সাথে 'ঘড়া' বাচ্ছুরি খুঁজতে যেতাম। কিছু পেতামও। আর কুড়ে নিয়ে আসতাম জঙ্গলী আলু। তবে খুব বেশী পেতাম না। হ্যাঁ, বলা হয়নি আমাদের পরিবারের সদস্যার শরনার্থী হওয়ার জন্য গেলেও বাবা যাননি। তিনি মা, মাটি আর মাতৃভূমির টানে বাড়ীতে রয়ে গেছেন। বাবা'র জন্য 'মা' সব সময় চিন্তায় থাকতেন। সেখানে আমাদের চাউলগুলো প্রায় শেষের পথে ছিল। তাই বাবা ২ দিন পর চাউল নিয়ে সেই বাঘমারায় গেছেন। দুপুরে আবার ফেরৎ এসেছেন।
বাঘমারা থেবে কয়েক কিলোমিটার গেলেই নাকি পৌঁছে যাওয়া যায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে।  প্রতিদিন হাজার জাজার মানুষ যাচ্ছে ভারতে শরনার্থী হতে। আমাদের তখনো যাওয়া হয়নি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনের জন্য বাঘমারায় প্রায় এক সপ্তাহ থাকতে হয়েছে আমাদের।
আহারে জীবন!  সবাই চলে যাচ্ছে শরনার্থী হতে।
পর্ব -৩
প্রতিদিন শত শত পরিবার ভারতে যাচ্ছে বাঘমার পথ দিয়ে।  আশ্রয় নিচ্ছে শরনার্থী হিসেবে। সে এক করুন কাহিনী। 
আহা! মানব জীবন!
কেউ ফেলে যাচ্ছে আপন আত্মীয়-স্বজন। প্রায় সবাই যাচ্ছে চোখের জল ফেলে ফেলে চোখ মুছে মুছে।
বিদায় নিচ্ছে আর বলছে কাকা-কাকি, মামা-মামি, দাদা-দিদি যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে কোনো এক সময়। এভাবে বলে বলে একে অপর থেকে বিদায় নিচ্ছে। আবার, কেউবা বাঘমারায় রেখে যাচ্ছে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি।  আহা! স্বপ্ন কত? বলছে কাল না হয় পরশু নিতে আসবো। কত কিছু স্বপ্ন তাদের। কেউতো আর আত্মীয়-স্বজন খোঁজ নিতে আসতে পারছে না। কেউ গরু-ছাগল নিতে আসতে পারছেনা।
কার গরু-ছাগল কে দেখে?
নিজে বাঁচতে পারছেনা আবার গরু-ছাগলের চিন্তুা? যে দিন আমরা বাঘমারায় আশ্রয় নিয়েছি সে দিন বাঘমারার ছড়ার পাশে বাঁশ পাতা, কলা পাতা আরো বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা দিয়ে আমরা ছোট ছোট খামার করেছি। সে সব খামারে মধু মঙ্গল পাড়া, অনিল পাগা, মুনি পাড়া, খেদার ছড়া পাড়া, কিনাধন বৈদ্য পাড়াসহ অনেক পাড়ার মানুষ বাঘমারায় অবস্থান নিয়েছি।  অবস্থানের তিন দিনের মাথায় গণহারে শুররু হলো ডায়রিয়া, সদ্দি, জ্বর, ম্যালেরিয়া। আমাদের দেখার কেউ নেয়। পার্টি(জেএস্েস)থেকে কিছু কিছু ঔযুধ দেওয়া হয়েছে।যা পর্যাপ্ত নয়। সে ঔযুধ দিয়ে কি আর হয়? দেখেছি কয়েক জনকে বিনা ঔযুধে মরতে। জ্বরের পরিমাণ বেশী হওয়ায় আমার এক ভাগিনা চোখ-মু উলোত-পালত করছে।আর কি যেন আবুল –তাবুল বলছে।  আর ২/৩ মিনিট পর জ্ঞান হারাচ্ছে। শুরু হয়েছে কান্নাকাটি। সৌভাগ্যক্রমে সে বেঁচে গেছে। সেই ভাগিনাটির নাম ফেলা রাম চাকমা। বর্তমানে সে অটোরিক্সা সিএনজি চালিয়ে জীবন নির্বাহ করছে। ডায়রিয়া প্রকোপ এত ছিল যে কমবেশী সবাই আক্রান্ত হয়েছে। তা থেকে কেউ রক্ষা পায়নি। চোখের সামনে অনেক লোক মারা গেছে। স্মৃষ্টিকর্তা সহায় ছিল বলে আমরা বেঁচে গেছি।
কার দুঃখ কে দেখে?
ডায়রিয়ার পরিমাণ বেশী হওয়ায় একজন লোক তার মা'কে ভারতে নিতে পারেনি। শুধু তার পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে চলে গেছে।  স্মৃষ্টি কর্তার আশায় নিজের মা'কে রেখে গেছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে 'মা' কাল তোমাকে নিতে আসবো।
ঐ লোকটি যাওয়ার দু'দিন পরেও মাকে নিতে আসেনি।
ডায়রিয়া কিছুটা ভালো হওয়ায় সে বিভিন্ন পরিবার থেকে খুঁজে খুঁজে ভাত খেত। আর বলত ’গুরো ধরি ধরি’ হেম। সে বৃদ্ধা মহিলাটি ছিল ধাত্রী। তাই সে গুরো ধরি ধরি হেম কথাটি বলত। অর্থাৎ সে ধাত্রী করে করে খাবে।
আমি ছিলাম ছোট।আমার বড় বোন আর আমার কাকাতো দু'ভাই ও বোন ঐ বৃদ্ধা মহিলাটির ভয়ে ঘর থেকে বের হতাম না। ছোট ছিলাম বিধায় আমরা বুঝতাম না। মনে করতাম আমাদেরকে ধরে ধরে খেয়ে ফেলবে।
 পর্ব -৪
বাঘমারা ফেলে যাওয়া সেই ধাত্রী এখনো আছে ছেলেয় আশায়।প্রহর গুনছে কবে নিতে আসবে তার ছেলে। তিন দিনের মাখায়ও আসেনি তাঁকে নিতে।  পাখি ডাকা ভোর সকালে বিলাপ করছে আর বলছে। এটা গ্রাম নয়।এখানে আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেয়। কে দেখবে আমার?  কে দেখাশোনা করবে?  কে লালন পালন করবে আমায়?
নাতিগুলোর জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছে। বয়স বেশ হয়েছে।  কাজও করতে পারবো না। আমার কপাল এত খাারাব কেন? জীবনে কি পাপ করেছি আমি? কি পাপের ফলে আজ আমার এ অবস্থা হলো। এভাবে বিলাপ করছে আর অঝোরে কান্না করে করে থাকে। যা শোনা যাচ্ছে আমাদের ঝুঁপড়ি কুড়ে ঘর থেকেও। এরপর থেকে ঐ ধাত্রীর নাম রেখে দিলাম আমরা 'ফেলেয় যেয়ে' বুড়ি ।
সকালে ভাত খাওয়ার আগে আমাদের কুঁড়ে ঘরে ভাতের প্লেট নিয়ে হাজির হলো  ফেলেয় যেয়ে বুড়ি। বলছে-আমাকে কিছু ভাত দেন। এরপর পাশে ঝুঁপড়ি ঘরে। এভাবে ভিক্ষা করে করে চলছে সেই বুড়ি। আমাদের ঘরে ভাতের জন্য আসায় সময় আমি খুব ভয় পেয়েছি। মনে করেছি আমাকে খাওয়ার জন্য এসেছে। সব সমময় মা'য়ে পাশে পাশে থেকেছি। কারণ সেই বুড়ি বলেছে 'গুরো ধুরি ধুরি হেম'। মানে ধাত্রী করে করে খাবে। সে কথা তখন বুঝায় সময় আমার হয়নি। তাই তাকে দেখলে প্রচুর ভয় পেতাম। বুড়ি চলে যাওয়র পর 'মা' আমাকে বুঝালেন সে তোমাদের ধরে ধরে খাবে না। সে হচ্ছে ঐঝা'/ধাত্রী। তখন আমার ভয় কেটে গেছে। খাবার খাওয়ার পর আমরা আমার গেলাম বাচ্ছুরি খুঁজতে। গেলাম সেই মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা শ্মশ্বানের পাশে। সাথে নিয়ে হেলাম কিছু সরিষার তেল। বাঁশের কুপি বানিয়ে সে উপরে তেল আর টেনা দিয়ে বাতি জ্বালিয় আমরা মানবেন্দ্র লারমার শ্মশ্বানে বাতি দিয়ে প্রণাম করলাম। এরপর আমরা বাচ্ছুরি খুঁজতে সেই পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে গেলাম। বেশ কিছু বাচ্ছুরি, কাঁকড়া,টেঁকি শাক নিয়ে বাসায় ফিরলাম। এসে দেখি আমাদের পাশ দিয়ে শত শত মানুষ ভারতে যাচ্ছে শরনার্থী হতে। চলে গেলে আমাদের সাথে থাকা অনেক পরিবারও। আমাদের ঝুঁপড়ি ঘর গুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। অর্ধেক পরিবার ভারতে গেছে শরনার্থী হতে। আমরা আছি বাবা'র অপেক্ষায়। এদিকে আমাদের ভাতের চাল শেষ হওয়ার পথে। বাবা একদিন পর আসার কথা এখনো আসেনি। আগামী কাল না আসলে আমাদেরকেও উপাস থাকতে হবে।
পর্ব-৫
অর্ধেক পরিবার ভারতে যাওয়ার আমাদের ঝুঁপড়ি কুড়ে ঘরগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে।
আমরা আছি বাবা'র অপেক্ষা।
ভাতের চাল শেষ হওয়ার পথে। বড় জোড় ৪/৫ বেলা খাবার হবে। মা আছে চিন্তায়।
বাবা আমাদের সাথে বাঘমারায় আসেনি। মা,মাটির টানে আমার বড় বোন পভূ লতা চাকমাকে নিয়ে মধুমঙ্গল পাড়ায় রয়ে গেছে।এদিকে জমিতে ধান ফেঁকে গেছে। গ্রামে নাকি ৩/৪ টি পরিবার রয়ে গেছে। তারাসহ বাবা আর বড় বোন একটা বাড়ীতে থাকে।
সবাই মিলে ধান কাটতে যায়। গরু ছাগলগুলো দেখাশুনা করে। বাজারে ধানের আঁড়ি(১০কেজিতে এক আঁড়ি) নাকি ২০/৩০ টাকাও বিক্রি হয় না। আর চাউল কেজি প্রতি ৫টাকাও বিক্রি হচ্ছে না।
আমাদের ঘর-বাড়ী আর বাগানগুলো প্রতি পক্ষের লোকেরা বাবা আর বড় বোনের চোখে সামনে ভেঙ্গে দিয়েছে আর মালামাল চুরি করে নিয়ে গেছে। তারা দূর থেকে তা দেখেছে। ঘরবাড়ী ভেঙ্গে দেওয়ার সময় বাবা আর বড় বোনের প্রতি পক্ষদের কাছে আসার সাহজ পায়নি।
৩ দিনের মাথায় বাবা আর বড় বোন চাউল নিয়ে বাঘমারায় এসেছে। আর হাজার খানেক টাকা মা'র কাছে জমা দিয়েছে। বড় বোনের কাছ থেকে ঘরবাড়ী ভেঙ্গে দেওয়া লুটপাত করার কথা শুনেছি।
ঘর-বাড়ী ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আমাদের হাতে তেমন টাকা-পয়সা ছিল নাহাতে টাকা পয়সা নাই। কিভাবে ভারতে যাবো। কিভাবে শরনার্থী হবো। যাওয়ার সাথে সাথে ছেলে-মেয়েরা কি খাবো।এ সব সলা পরামর্শ করছে বাবা আর মা।
ভারতে শরনার্থী হতে যাবে কি যাবে না এ নিয়ে মহা চিন্তায় পড়ে গেছে তাঁরা। থাকলে কিভাবে থাকবে এখানে। সবাইকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে শরনার্থী করানোর জন্য।
দু'একদিন পর সবাইতো চলে যাবে শরনার্থী হতে। এখানো থাকলে আমাদেরও শরনার্থী হতে যেতে হবে। শরনার্থীতে না যাওয়ার বিকল্প পথ খুঁজতেছে বাবা।
এদিকে দুপুরে সেই ধাত্রীটি আবার ভাত খুঁজতে এসেছে আমাদের কুঁড়ে ঘরে। মা' তাঁকে এক প্লেট ভাত আর তরকারী দিলেন। আমার, আমার বড় এক বোনে ডাইরিয়া হয়েছে। নেই কোনো ঔযুধ। শুধু গরম পানি আর জঙ্গলের লতাপাতা দিয়ে বানানো ঔযুধ খেয়েছি। সৃষ্টিকর্তা সহায় হওয়ায় আমরা ভালো হয়েছি। সেই দুঃখের সময় কিনা ধন বৈদ্য পাড়ার এক বুড়ো লোক একটি রেডিও নিয়ে গেছে। সেই বুড়ো লোকটি অনেক বড় বড় করে গান আর খবরগুলো শুনে। তাঁকে অনেকই বলেছে বড় বড় করে গান না শুনার জন্য। সে কারো কথা শুনেনা।সে সব সময় বড় বড় করে গান শুনে।বুড়ো লোকটির পাশে ঝুঁপড়ি ঘরে ডাইরিয়ায় একটি শিশু মারা গেছে। তার আত্মীয় -স্বজন কান্নাকাটি করছে আর বিলাপ করছে। তারপরও ঐ বুড়ো লোকটি গান শুনছে।সে এক মহা বিরক্তিকর। এদিকে ৩ দিনের মাথায়ও ঐ ধাত্রীকে নিতে আসেনি তাঁর ছেলেটি।তাই সেই ধাত্রীটি কপালে হাত দিয়ে বলছে বুড়ো বয়সে এ দুঃখে পড়ার জন্য ছেলে-মেয়ে বড় করেছি।
হায় কপাল আমার! ভগবান, ইশ্বরকে ডেকে ডেকে এ সব বিলাপ করছে।
বিকালে শরনার্থী যাওয়ার জন্য অনেক পরিবার প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। গাইডারগুলো তাদের নিয়ে যাবে। আমরা আজ যাবো না বলে গাইডারদেরকে বলেছে বাবা।কাল যাবো, পরশু যাবো বলে বলে সময় পার করছে বাবা। এখনো রয়েছি বাঘমারায়।
পর্ব-৬
আহা! কি আনন্দ সেই বুড়ো লোকটির। কিনাধন বৈদ্য পাড়ায় তাঁর গ্রাম। নাম পন চোগা চাকমা। সেই পাখি ডাকা ভোর থেকে রেডিওতে গান শুনে।বড় ভাই প্রভূ মুনি চাকমা ডায়রিয়া হয়েছে। সাথে জ্বরও।রাতভর পায়খানায় আসা-যাওয়া করেছে।
যেন কিছুতেই ভাল হচ্ছেনা। সকালে গাছের শিকড় আর বাকল দিয়ে এক প্রকার ওযুধ বানিয়ে খাওয়ানো হয়েছে। সেই থেকে কিছু ভাল রয়েছে। আমাদের পাশে সেই রেডিও ওয়ালা পনচোগা চাকমাদের ঝুঁপড়ি ঘরটি।
রেডিওটি বন্ধ করার করার জন্য মা অনেক বার বলেছে। তবুও শুনেনি। আমাদের আশেপাশের বেশ কয়েকজন মুরুব্বী গিয়ে বাঁধা দেওয়ায় সে রেডিওটি বন্ধ করে রেখেছে।
ঝুঁপড়ি ঘর গুলো গতরাতে আরো বেশী খালি হয়ে গেছে।
গতকাল বিকালে অর্ধেক পরিবারকে নিয়ে গেছে গাইডারগুলো। তাদেরকে নেওয়া হয়েছে ত্রিপুরা রাজ্যের করবুক নামক জায়গায়। তাদেরকে শরনার্থী করানোর জন্য তালিকা করানো হচ্ছে। ঘরবাড়ী নেই। তাই রাতদিন খোলা আকাশে থাকতে হচ্ছে সেই পরিবারগুলোকে। আজ বিকালে আমাদেরকে নেওয়া হবে বলে গাইডারগুলো জানিয়ে দিয়েছে। বড় ভাইয়ের ডাইরিয়া ভালো না হওয়ায় আমাদেরকে নেওয়া হয়নি। আর সেই রেডিও ওয়ালা বুড়ো লোকটির পরিবারও চলে গেলে শরনার্থী হতে। ধাত্রীর ছেলেটি গতকাল রাতেও আসেনি মা'কে নিতে। অনেকের অনুরোধে গাইডারেরা সেই ধাত্রীকে নিয়ে যায়। সর্বশেষ তাঁর ছেলেকে খুঁজে ফেল কিনা জানানো সম্ভব হয়নি। তবে সেই ধাত্রীকে মনে পড়লে আমার আজও মন কাঁদে। সর্বশেষ ২০/৩০টি পরিবার রয়ে গেলাম বাঘমারায়। এদিকে বাবা আর অন্যান্য রা শরনার্থী না যাওয়ার সলা পরামর্শ করছে। প্রায় পরিবারগুলোকে শরনার্থী করতে পারাতে গাইডারগুলো এখন অনেকটা সুর নরম করেছে। যারা স্বেচ্ছায় শরনার্থী হতে যাবে না তাদেরেকে আমরা জোর করে নেবো না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তবে যারা গ্রামে ফিরে যাবে তারা বিপদে পড়লে কেউ দায়ী থাকবেনা বলেও জানিয়ে দেয়। গ্রামের পরিস্থিতি ভয়াবহ রয়েছে। এতকিছু শোনানোর পরও আমরা স্বেচ্ছায় ভারতে যায়নি। হতে যায়নি শরনার্থী হতে। আজ রাত সেই পরিবারগুলো বাঘমারা থেকে গ্রামের বাড়ীতে ফিরে আসলাম। ফিরে এসে দেখি আমাদের বাড়ীঘর ভেঙ্গে ফেলে দেওয়া হয়েছে। চুরি করা হয়েছে মালামাল। চারিদিকে জনশূণ্য।গ্রামগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে।
পর্ব-৭
আমাদের গ্রামের অর্ধেকরও বেশী পরিবার বাঘমারা থেকে ফেরৎ আসেনি।
তারা শরনার্থী হতে গেছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। পরবর্তীতে শুনলাম শরনার্থী হওয়া পরিবারগুলোও ভাগ হয়েছে।কিছু পরিবার করবুক শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। আবার কিছু পরিবারকে ভারতের শীলাছড়িতে নিয়ে গেছে। গ্রামে ফেরৎ পরিবারগুলো সব সময় আতঙ্কে থাকি।পরিস্থিতি কখন কি হয় তাই। চারিদিকে জনশূণ্য। গ্রামগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। নতুন করে ঘরবাড়ী তোলা হয়েছে। শুরু হয়েছে নতুন করে কর্ম জীবন। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর মাস খানেক পরে স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। তখন তৃতীয় শ্রেণি পড়ি। অর্ধেক বন্ধু রইলাম স্কুলে। এভাবে থাকতে থাকতে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে ফলাফল ফেলাম। আমার রোল হল ৪।
১৯৮৭ সালে ৪র্থ শ্রণিতে উঠলাম। গ্রামের আশেপাশে কোনো দাকানপাত ছিলনা। কোনো কিছু কিনতে হলে বাজারে যেতে হতো তাও বড় জনেরা বাদে কেউ বাজারে যায় না।
সপ্তাহে একদিন পানছড়ি বাজার বসে। বাজার থেকে প্রতিজনে কেরোসিন ১ কেজি আর ১ পোয়া দ্রব্যমূল্য আনার অনুমতি ছিল। কখনো বেশী আনা যেত না। বেশি আনলে বাঁধার মুখে পড়তে হতো। সেই ১ কেজি কেরোসিন দিয়ে পুরো সপ্তাহ পার যেতো না।আর ১ পোয়া শুটকি দিয়েও সপ্তাহ যেত না। আমাদের উৎপাদিত মালামাল সস্তা দামে বিক্রি করতে হতো। আমরা চার ভাইবোন (বড় ভাই প্রভূমুনি চাকমা কলেজে পড়ে, বড় কোন জোনাকি চাকমা,সাগরিকা চাকমা আর স্কুলে পড়ি) এক সাথে লেখাপড়া করি।
তাই ১ কেজি কেরোসিন দিয়ে সপ্তাহ পার হতো না। দিনের আলোয় লেখাপড়া শেষ করতে হতো। এভাবেই চলছে আমাদের জীবন।
পর্ব-৮
চার ভাইবোন একসাথে লেখা-পড়া করার কারনে ১ কেজি কেরোসিন দিয়ে সপ্তাহ পার হতো না। তাই দিনের আলোয় লেখা-পড়া শেষ করতে হতো। তখন পানছড়ি বাজার ও লোগাঙ বাজার বাদে পূজগাঙ এ কোনো দোকানপাত ছিলনা। এভাবে লেখা-পড়া চালিয়ে গিয়ে ১৯৮৭ইং সালে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলে রোল ২ হয়ে ১৯৮৮ ইং সালে ৫ম শ্রেণিতে উত্তীর্ন হই। আর রোল এক হলেন নন্দ লাল চাকমা। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর সাথে পারিনি। তখন সে তাঁর দাদু বাসায় থাকত। তাঁর দাদুর নাম ছিল মজেন্দ্র লাল চাকমা। তিনিই আমাদের স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। মজেন্দ্র লাল স্যার থেকে সকাল বিকাল প্রাইভেট পড়তেন। প্রাইভেট আমার ভাগ্যে জুটেনি। যা পেরেছি নিজের ইশ্চায়।খুব বেশী সমস্যা হলে বড় ভাই প্রভুমুনি থেকে শিখে নিতাম।
মজেন্দ্র স্যার ছিলেন খুবই দক্ষ একজন শিক্ষক।শুনেছি তখনকার সময়ে তিনি নাকি ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এরপর শিক্ষকতা চাকরি পেয়েছেন। বাংলা, ইংরেজী আর গণিতে তিনি খুবই দক্ষ শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃত মনা ব্যাক্তিও। তাঁর ব্যাক্তি জীবনী, বিভিন্ন গল্প, নাটক লিখে গেছেন। তখনকার প্রকাশনার উদ্যোগ না থাকায় সেগুলো তেমন প্রকাশিত হয়নি।
তবে এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।
তাঁহার লেখা চাকমা নাটক "রঙ মালা" টি শুটিঙ করা হয়েছে। তখনকার ভিডিও করার কোন কিছু না থাকায় তা সংরক্ষণ করা যায়নি। সেই "রঙ মালা" নাটকটি এলাকায় বিশাল
জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সে নাটকটি পরিবেশন করার জন্য নেওয়া হতো। নাটকটি শুরু হয়েছে সেই ১৯৮৬ সালের আগে। আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম। বড় ভাইবোন বা মা'য়ের সাথে দেখতে যেতাম।
রাজা-মন্ত্রী, সেনাপতি ছিল সেই নাটকে। নাটকে "উজু আর বেঙআ" নামক দুজনের যুদ্ধগুলো এখনো মরে পড়ে। ১৯৮৮ইং সালে ৫ শ্রেণিতে উঠার পর আমার লেখা-পড়ার চাপ আরো বাড়তে
থাকে। আমার বড় ভাই প্রভূমুনি চাকমা থেকে সহযোগিতা নিতাম আর আমার এক কাকাতো ভাই বুদ্ধ জয় চাকমা থেকেও সহযোগিতা নিতাম। প্রভূমুনি চাকমা আর বুদ্ধজয় চাকমার হাতের লেখাগুলো খুবই সুন্দর ছিল।তাঁরা দু'জনই কলেজে পড়তেন। বড় ভাই প্রভূমুনি চাকমা লেখতেন বাম হাত দিয়ে। বাংলা, ইংরেজী লেখাগুলো খুবই সুন্দর ছিল। ১৯৮৮ সালে ৫ম শ্রেণিত পড়ি। তখনও আমি মা'য়ের বুকের দুধ খেতাম। সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে মাকে বলতাম মা একটু দাঁড়াও। তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুধ খেতাম। এরপর স্কুলে যেতাম। আমাকে মা'য়ের দুধ না খাওয়ার জন্য বড় ভাই খুব বেশী বাঁধা দিতেন। তবুও খেতাম। বড় ভাই একদিন একটি ছোট বল এনে দিয়ে বললেন মা'য়ের বুকের দুধ ছাড়লে তোমাকে এ বলটি দিয়ে দিবো।
বল পেয়ে অনেক খুশি হয়েছি। প্রায় এক সপ্তাহ পর্ষনাত মা'য়ের বুকের দুধ খাইনি।
তখন আমাদের উঠানে ছিল একটি খেজুর গাছ। দুই ভায়ে খেলা খেলতে খেলতে তিনি খুব বড় করে লাঠি দিয় বল আকাশের দিকে তুলে দিলেন। বল পড়ে গেল সুপারি গাছের কাদায়। নষ্ট হলো বলটি। সেদিন বিকাল থেকে আবার মা'য়ের দুধ খাওয়া শুরু করলাম।
পরবর্তীতে আর একটা বল পাওয়ায় মা'য়ের বুকের দুধ খাওয়া বন্ধ করি।
আজ মা নেয়। তিনি ২০০৩ইং সালে ডিসেম্বরে শেষের দিকে স্বর্গীয় হন।
মাঝে মাঝে সেই কথাগুলো মনে পড়লে কখন চোখের পানি আসে ঠেরও পায়নি।
পড়ে যায় আবেগের স্রোতে। মা'কে তাঁর বৌ মা'কে দেখাততে পারিনি। মা'ও বুকভরা দুঃখ নিয়ে স্বর্গীয় হন। আর আমি মাঝে মাঝে আফসোসে পরে আবেগের সোতে ভেসে যায়।

বড় ভাই প্রভূমুনি চাকমা ছিলের খুবই সুন্দর মানুষ। গায়ের বঙ ছিল খুবই ফর্সা। অচেনা লোকে দেখলে বলতো এ ছেলেটি কার? রাজপুত্রের মতো চেহারা।এভাবে বলাবলি করতে নিজে অনেকবার শুনেছি।
হ্যাঁ দাদা ছিলেন খুবই সুন্দর চেহারাবান আর ফর্সা একটা পুরুষ। বড় ভাইকে মা-বাবা বাবু বলে ডাকতেন। এপ্রিল মাসে আমাদের পরিবারে বিরাট করে ঝড় বয়ে গেল। বিঝুর কাছাকাছি সময়ে বড় ভাই প্রভূমুনি চাকমা স্ত্রোক করে স্বর্গীয় হয়। তখন বাবা আর মা প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। বাবা-মা ঘন ঘন মুর্ছা যান। বাব আর -মা'তো দাদার চিতার সাথে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরতে চাইছিলেন।
আত্মীয়-স্বজনগুলো ধরে রাখাতে তাঁরা আগুনে পুড়ে জ্যান্ত মরতে পারেনি। মা আর বাবা না খেয়ে থেকেছে অনেক দিন। না খেয়ে থাকতে থাকতে মা'তো উঠতে বসতেও পারতেন না। আমরা অনেক কৌশল করে পানি নাম দিয়ে ভাতের মার খাওয়াতাম বাবা আর মাকে । আর বাবা পাগলের মতো করে সারাদিন গ্রামে ঘুরতেন।
বলতেই ঐ যে আমার বাবু। দেখতে পাচ্ছি।তাই বলে সেদিকে দৌঁড় দিতেন। গ্রামের যেদিকে যান সেদিকে দাদাকে দেখবেন মনে করতেন। তাই না খেয়ে পাগলের মতো করে পুরো গ্রাম ঘুরতেন । বাসায় আসলে বাবু, ঐ বাবু.... বলে ডেকে ডেকে মুর্ছা যেতেন। তখন সবাই মিলে অঝোরে কান্না করতাম।
পর্ব-৯
বড় ভাই প্রভু মুনি চাকমার সাপ্তাহিক ক্রিয়া শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরে শুরু আমাদের প্রধান সামাজিক উৎসব বিঝু। তাই সে বছর বিঝু উৎসব হয়নি আমাদের পরিবারের। বাবা আর মা বড় ভাই প্রভূ মুনি চাকমার বন্ধু-বান্ধবদের দেখলে অঝোরে কান্না করতেন। বিশেষ করে তাঁর সহপাঠী বুদ্ধজয় চাকমা, শিমুল চাকমা(স্বর্গ ধন চাকমা), রুপান্ত চাকমাদের দেখলে শুধু বিলাপ করে করে কান্না করতেন। তাই তাঁরা আমাদের বেড়াতে আসতেন না। দুই ভাই থেকে এক ভাই হওয়ায় সেই আগের দিনের কুসংস্কারে ধরে আমার বাম কান ফুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।অর্থাৎ আমাকে ক্ষত করা হয়।যেন আমি মরে না য়ায়। প্রায় দু'মাস পরে আমাকে স্ব-ধর্ম রীতিনীতি অনুসারে আমাদের জন কল্যাণ বৌদ্ধ বিহারে শ্রমণ করে দেওয়া হয়। সাত দিন থাকার কথা থাকলে আমি প্রায় ১০ দিন ছিলাম শ্রমণ অবস্থায়। এরপর রঙ বস্ত্র ছেড়ে বাড়ীতে আছি।
মা-বাবা আস্তে আস্তে  কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকেন। গ্রামের আত্মীয়-স্বজন বাবা মাকে বুঝাতে থাকেন। ২ ছেলের মধ্যে এক ছেলেকে হারালেও আর এক ছেলে আছে।এ ছেলেকে নিয়ে ভরসা করে থাকেন।এভাবে আরো অনেক কিছু।
আমি ৫ শ্রণিতে পড়তেছি। তাই আমাদের স্কুলের সে সময়ের প্রধান শিক্ষক যুদ্ধ চন্দ্র চাকমা প্রায় সময় আমাদের বাসায় আসতেন।বাবা-মাকে বুঝাতেন।আত্মীয় সম্পর্কে তিনি আমার কাকা হন। আবার আমরা এক গোষ্ঠীও।
আমার রোল ২। তাই বৃত্তি পরীক্ষা যেতে হবে।সেজন্য পস্তুতি নিতে তিনি আমাবে উৎসাহিত করেন। আরা বাবা-মাকেও বুঝান।
এরপর ডিসেস্বরে আমাদের বার্ষিকী পরীক্ষা হয়। কয়েক দিন বৃত্তি পরীক্ষা বৃত্তি পরীক্ষার জন্য পানছড়ি বাজার মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষা পস্তুতির জন্য আমার কোনো গাইড লাইন ছিলনা।পরীক্ষায় আমি ভালো করতে পারিনি।
তবু পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ন হয়ে ১৯৮৯ইং সালে পূজ গাং মূখ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। প্রায় ৪ মাস ক্লাশ চলার পর পাহাড়ের পরিস্থিতির কারনে আবার ভাবতে শরনার্থীতে হতে হয়েছে। শরনার্থীতে মা, আমার বড় বোন জোনাকি চাকমা, সাগরিকা চাকমা গিয়েছি। এবারও আমাদের সাথে শরনার্থী হতে যাননি বাবা আর বড় বোন প্রভূ লতা চাকমা। বর্তমানে চয়েস মা। তারা এক সপ্তাহ পরে শরনার্থী হতে গেছেন। তাই তাঁরা আলাদা কার্ডে আর আমরা আলাদ কার্ডে রেশন পেয়েছি।
সেখানে গিয়ে আমাদদের করবুক শরনার্থী শিবিরে থাকতে হয়েছে। লেখাপড়া বন্ধ হয়েছে আমাদের। নতুন নতুন জায়গা।নতুন পরিবেশ, আমাদের খাপ-খাইয়ে নিতে অনেক কষ্ট হয়েছে।
প্রতিদিন বেশ কয়েকজন লোক মারা যাচ্ছে। সে এক করুন কাহিনী।
শিবিরে যাওয়ার ১ সপ্তাহের মাথায় আমার আর বড় বোন সাগরিকা চাকমা ডাইরিয়া হয়েছে।ডাইরিয়া থেকে অমাশয় হয়েছে আমাদের দুই ভাই বোনের। শিবির থেকে পায়খানা ঘর অনেক দূরে।পায়খানা করতে করতে আমরা খুবই দুর্বল হয়ে পড়ি। পায়খানা করতে করতে পরবর্তীতে মল আসেনা। আছে শুধু কিছু রক্ত। আমরা খুবই দুর্বল হয়ে পড়ি।
আমাদের অবস্থা দেখে মা পায়খানা করার জন্য ঘরের ভিতরে ছোট্ট গর্ত করে দেন।সেখানে পায়খানা ছাড়তে হয়েছে।
কোনো ডাক্তারি ঔযুধ না থাকায় জঙ্গলে লতাপাতা আর কি একটা গাছের বাকল বাঁশের চুঙ্গায় সিদ্ধ করে খাওয়ানো হয়েছে।
প্রায় ৪/৫ দিন পর আমরা আস্তে আস্তে সুস্থ হতে থাকি। সে সময় দেওয়া হয়েছে লাল সিদ্ধ চাল।যা খাওয়ার উপযোগি নয়। তবুও খেতে হয়েছে।
আহা!
শরনার্থীতে পাওয়া ডাইল তরকারী আর সেই লাল চাউলের ভাত গুলো ২/৩ বার খেলে ভাল শরীরও নিজে নিজে দুর্বল হয়ে যায়। টাকা ন থাকায় তবুও খেতে হয়েছে। আমাদের দু'ভাইবোনের অবস্থা দেখে মা সে লাল চাউলগুলো বিক্রি করে কয়েক কেজি আতপ চাউল কিনে আনেন।সে আতপ চাউলের ভাত খেতে পেয়ে দু'ভাইবোন কিছু স্বাভাবিক হতে থাকি।
পর্ব-১০
লাল চাউলগুলো বিক্রি করে কয়েক কেজি মাত্র আতপ চাউল কিনে এনেছেন মা। কয়েক সন্ধ্যা খাওয়ার পর সেই আতপ চাউলগুলো শেষ হয়েছে। মার হাতে টাকাও নেই। তাই অন্যের থেকে চাউল ধার করে খেতে হয়েছে আমাদের। ২দিন পর বাবা বাংলাদেশ থেকে শরনার্থী শিবিরে আসলেন। বাবা কিছু টাকা এনেছেন। চাউল নাই শুনে বাবা একবস্তা আতপ চাউল কিনে এনেছেন। সেই আতপ চাউল খেয়ে দুই ভাইবোন সুস্থ হয়ে উঠি।
আমাদের শরনার্থী শিবির থেকে শরনার্থীদের পরিচালিত স্কুলের দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার হবে। টাকা পয়সা না থাকায় আমরা স্কুলে ভর্তি হতে পারিনি। তাই স্কুলে যাওয়া হয়নি।
আমাদের গ্রাম থেকে ১৯৮৬ সালে যাওয়া শরনার্থীরা করবুকের শিবিরে অবস্থান করতেছে।
সেই শিবির থেকে আমাদের শিবিরের দূরত্বও প্রায় ২ কিলোমিটার।
একদিন সকালে মা'র সাথে আমি আর আমার কাক তো ভাই ঐরাশা মুনি চাকমা করবুক বাজারে যাচ্ছিলাম। আমার কাকাতো ভাই ঐরাশা মুনি আমার থেকে বয়সে ৬মাসের ছোট।
আমাদের পিছনে কয়েক জন রিয়াং মহিলা আর দু'জন আমাদের সম বয়সি ছেলে স্কুলে যাচ্ছে। মেয়েগুলো নীল রঙয়ের শাড়ী পড়া। ৯শ্রেণিতে উঠলে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সে সময়ে বাধ্যতামূলক শাড়ী নাকি পড়তে হয়। সম্ভবত মেয়েগুলো ৯/১০ ক্লাশে পড়ে।
আমি আর ঐরাশা মুনি মা'য়ের পিছে পিছে যাচ্ছিলাম। আমাদের পিছনে পিছনে আসা দুইটা ছেলে থেকে একটা ছেলে আমার কাকাতো ভাই ঐরাশা মুনি পিছন থেকে এসে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। শব্দ শুনে পিছনে দেখি ভাই মাটিতে পরে গেছেন।
তখন বললাম ভাই কি হয়েছে বলাতে সে বলল ঐ ছেলেটা ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দিয়েছে। আমি রাগ করে ভাইকে বললাম তুমি চালিয়ে দাও। আমি ঐ ছেলেকে মারার জন্য দৌঁড়ে গেলাম।
আমি ঐ ছেলেকে মারার যাওয়ার আগে শাড়ী পড়া এক শিক্ষার্থী(মেয়ে) ধাক্কা দেওয়া ছেলেকে কয়েকটা ঠাপ্পর দিলেন। আর তাদের ভাষায় কি জানি বলেছেন। শাড়ী পড়া মেয়েটি সম্ভবত তার বড় বোন হবে। আমার রাগের সুরে কথা শুনে মা বলতেছে কি হয়েছে। আমার কাকাতো ভাই মাকে সব বলে দিলেন। মা বললেন তোমরা কিছু করোনা। এটা আমাদের দেশ নয়। চুপ করে থাক।
ঐ শাড়ী পড়া মেয়েটি আমার ভাইকে বলেন তোমরা যাও গা। আর ভাই শান্তনা দিয়ে বললেন ভাই গচ্ছা(রাগ) করো না। তারপর আমরা কিছু না বলে চলে আসলাম মা'য়ের সাথে চলে আসলাম।
পর্ব-১১
সে দিন করবুকের মূল শিবিরের (অর্থাৎ যারা ১৯৮৬ সালে শরনার্থী হয়েছে) বাজার থেকে বাজার করার পর আমরা আমাদের শিবিরে ফিরে আসলাম। আমাদের শিবিরে সামনে একটা মাচাং ঘর তোলা হয়েছে। কে তুলেছে জানি না। সকাল থেকে বিকাল সেই ঘরে গল্প দিতাম। খাবার খাওয়া আর রাত্রি বাদে সেই ঘরে দিনভর লুডু খেলা, তাস খেলা খেলতাম। স্নান করার জন্য আমাদের শিবিরের সামনে বড় গর্ত করে কুয়া বানানো হয়েছে। সেই কুয়া থেকে খাবার পানি, স্নান করা মানে সব কিছু করতে হতো। সকালে আর বিকালে পানির সংকট হতো প্রচুর। ভোরে স্নান না করলে দিনভর স্নান করা হতো না। তাই মেয়েদের সেই পাখি ডাকা ভোর থেকে পানির জন্য যুদ্ধ করতে হতো। দেরি হলে পানি পাওয়া যেত না। এভাবে প্রায় ৩/৪মাস কেটে যায়।
বাবা আর দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় হরি পদ চাকমা(চম্পা বাব, কয়েক বছর আগে তিনি স্বর্গীয় হয়েছেন) প্রায় সময় তবলছড়ির ফেনীর জলেয়ে নামক জায়গা দিকের মাছ ধরার জাল দিয়ে মাছ ধরতে আসতেন। বিকালে ফিরতেন খালি হাতে।
এভাবে বেশ কয়েক বার আসার পর একদিন মাকে জিজ্ঞেস করলাম বাবা আজও মাছ পাননি?
একবারও তো মাছ নিয়ে আসলেন না কেন? এমন প্রশ্ন করার পর মা বললেন তোমরা কাউকে বলবে না শিবির থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তা খুঁজতে যায় তারা। অন্যরা জানতে পারলে সমস্য হবে। কাউকে বলা যাবে না।
আমাদের শিবিরগুলো ছিল অনেক লম্বা লম্বা। এক শিবিরে প্রায় ২০/২৫ টি পরিবারকে থাকতে হতো। শিবিরগুলোর প্রস্থ ছিল ৬/৭ হাত।
প্রতিজনের জন্য বরাদ্ধ ছিল দৈর্ঘ্যের ১ হাত। আমাদের পরিবারে সদস্য ছিলাম দুটি রেশন কার্ডে ৬ জন। তাই আমরা ৬হাত শিবির বরাদ্ধ পেয়েছি। সেই ৬হাত শিবির ঘরে রান্না করা, খাওয়া আর ঘুমানো। প্রতি দশ দিনে রেশন দেওয়া হতো জনপ্রতি ৪ কেজি ২৫ গ্রাম। মাঝে মাঝে চাউলের পরিবর্তে দেওয় হতো ছিড়া। আমার সম বয়সী অনেকেই স্কুলে যায়। আমাদের তিন ভাইবোনের স্কুলে যাওয়া হয়না। একদিন মা'য়ের সাথে আমি রেশন তুলতে গেলাম।
ছোট ছিলাম তাই চাউল আনতে পারিনি।তাই আমাকে শুটকিগুলো আনার জন্য বলা হয়েছে। ভারতের প্লাস্টিকের বেগ নিয় আমি শুটকি আনতে গেলাম ডিলারের কাছ থেকে।
শুটকিগুলো আনার সময় অর্ধেক পথে শুটকির দাত আর কাটার কারনে আমার প্লাস্টিকের ব্যাগ ছিড়ে যায়। আর সাথে সাথে অর্ধেক শুটকি রাস্তায় পরে যায়।
পর্ব-১২
শুটকিগুলো রাস্তায় পড়ে যাওয়ায় আমি কান্না শুরু করি। টাকার অভাবে মাছ,মাংসা কিনে খাওয়া হয়না। শুটকিগুলোই হলো মাছ আর মাংস। আমার কান্না দেখে মা তাড়াতাড়ি এসে চাউলের কাল্ল্যোঙটি( বাঁশের বেট দিয়ে তৈরী) মাটিতে রেখে শুটকিগুলো তুলে নিলেন কাল্ল্যোঙ এ। অবশিষ্ট শুটকিগুলো ব্যাগে নিয়ে আসলাম। আমাদের শিবিরে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হচ্ছে। শ্বশ্মানের পাশ দিয়ে আমাদের আসা-যাওয়া করতে হয়। শ্বশ্মানে ৪টি চিতায় আগুন জ্বলছে। সেই চিতাগুলো দেখে আমি মায়ের পিছু ছাড়িনি। মায়ের পিছনে পিছনে এসেছি। শুধু আজ নয় প্রতিদিন বেশ কয়েকজনের দেহ শ্বশ্মানে পোড়ানো হয়। শিবিরে আর শ্বশ্মানে প্রতিদিন কান্নার রোল পড়ে যায়। প্রায় সবাই বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। শিবিরে দুই-এক জনের ডায়রিয়া হলে পুরো কয়েকটি শিবিরে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। আর অনেকেই জঙ্গলের লতাপাতা, গাছের শিকর দিয়ে তৈরী ঔযুধ খেয়ে সুস্থ হয়। তাও আবার ভগবানের অপার কৃপায়। শিবিরে মারা যায় বিশেষ করে ডায়রিয়ায়।

বাড়ীতে এসে দেখি শুটকিগুলোতে অনেক পোকা। পোকাগুলো শুটকিগুলোকে খেয়ে সাবার করে ফেলেছে। সেগুলো পরিস্কার করে রেখেছে মা। কয়েকদিন পর পর সে শুটকিগুলো রান্না করে খাওয়াতেন। শুটকিগুলোতে মাংস বলতে ছিলনা। তবুও খেতে হয়েছে মাছ, মাংসের পরিবর্তে। মাছ, মাংস মাসে একবার জুটে না বললেই চলে। আমাদের শরীর দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে ভিটামিনের অভাবে। মা-বাবা চিন্তায় পড়ে গেছে। অন্যের ঘরে কাজ করলে পেটে-ভাতে হলে দৈনিক মিলে ভারতীয় রুপি ৭/৮ টাকা। খারাব ছাড়া ১১/১২ টাকা। অথচ এক কেজি চাউল কিনতে লাগে কমপক্ষে ২০ টাকা। বাবা-মা অন্যের ঘরে কাজ করতে পারেনা।
মা আর বাবা বলেনন-
সারা জীবন অন্যের ঘরে কাজ করিনি। আমরা গাবুর(মজুরির লোক) নিয়ে কৃষি কাজ করেছি। এখানে এসে কিভাবে মজুরি করতে যাবো? তাছাড়া দৈনিক কাজ করলে এক কেজি চাউল পাওয়া যায় না। তাছাড়াও সেই পাখি ডাকা ভোরে স্থানীদের ঘরে ঘরে গিয়ে কাজ খুঁজে নিতে হয়। যারা কাজ পায় তারা করে। আর যারা কাজ পায় না তারা খালি হাতে ফিরে আসে। অনেক স্থানীয় আছেন খুবই ভালো।আবার অনেকই নাকি খুবই খারাব। অনেক স্থানীয় আছেন সারা দিন কাজ করেও নাকি মজুরির টাকা না দিয়ে খালি হাতে ফেরৎ দেন মজুরকে। দিনভর কাজজ করার পর বিকালে মজুরি টাকা খুঁজতে গিয়ে অনেকে টাকার পরিবর্তে মার(পিটা)খেয়ে বাসায় ফিরে এসেছে। তবুও পেটের জ্বালায় আবারও স্থানীয়দের কাছে সেই পাখি ডাকা ভোরে গিয়ে কাজ খুঁজতে যায়। এছাড়াও নাকি অনেক বঞ্চনার শিকার হতে হয় । সব স্থানীয় কিন্তু খারাব ব্যবহার করে না।অনেকেই ভালো ব্যবহার করে। কাজ করার সময় বলে দেয়- নিজের মতো করে কাজ করতে। আর খাবারের সময় নাকি অতিথির মতো করে পরিবেশনও করে। যারা ভালো পরিবার ও ভালো মনের মানুষের কাছে কাজ পায় তারা বিকাল হলে খুঁশি মনে বাড়ীতে ফিরে আসে। আর যারা খারাব মানুষের কাছে কাজ পায় তারা খালি হাতে ফিরে আসে। অনেকেই মজুরির টাকা খুঁজতে গিয়ে মার(পিটা) খেয়ে খালি হাতে শিবিরে ফিরে আসে।
চলমান-১৩